নাসীমুল বারী
প্রচণ্ড ক্ষেপে যায় আওরা।
আওরা আরবের সম্ভ্রান্ত মহিলা। হারব ইবনে উম্যাইয়ার কন্যা। আরবের শীর্ষ নেতা আবু সুফিয়ানের বোন। শুধু তা-ই নয়, আরবের সবচে’ বনেদী পরিবার কুরাইশ বংশের বৌ— আবু লাহাবের স্ত্রী। তাকেই কিনা আবদুল্লাহর এতিম পুত্র মুহাম্মদ বলেছে ভবিষ্যতে কাঠকুড়ানী হবে। আরবের কাউকে উপহাস-তিরস্কার করার সবচে’ জঘন্য উপমা এটি। এত বড় কথা!
রাগ আর ঘৃণায় ফেটে যাচ্ছে আওরা।
আবু লাহাবও।
স্থির থাকতে পারছে না তারা দু’জন। কথাটা শুনেই আবু লাহাব এক শিষ্যকে পাঠায় কথার সত্যতা যাচাই করতে। সত্যি হলে আওরা এবার নিজেই খুন করবে মুহাম্মদকে। তার রক্তে মনের জ্বালা মিটাবে।
আওরার বিরক্তিটা আবু জাহলের উপরও পড়ে। কেন যে সেদিন পারল না তাকে হত্যা করতে— ভেবে পায় না। কী সব কথা বলছে আবু জাহল! এসব কি বিশ্বাসযোগ্য কথা? সে নাকি কাবাঘরে মুহম্মদকে হত্যা করার সময় আগুন দেখেছে। ওর সামনেই আগুনের পরিখা ছিল, অথচ কাবা পুড়ল না। এটা কি বিশ্বাসযোগ্য কথা!
ভাবতে থাকে আওরা।
এই তো ঘটনাটা ক’দিন আগের।
কাউন্সিল সভা।
নয়জন সদস্যের সবাই উপস্থিত। স্থানটা আবু সুফিয়ানের ঘর। সভাপতি হিসেবে আবু সুফিয়ান। প্রধান বক্তা দুইজন; আবু জাহল ও আবু লাহাব। আজই তারা সিদ্ধান্ত নিবে; গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদের ইন্দ্রজালী প্রভাব পুরো আরব গোত্রসমূহে ছড়িয়ে পড়ছে। এটা রুখতে হবে। কীভাবে রুখবে? সে নিয়েই আজকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সভা।
আবু সুফিয়ান কুরাইশদের অনেক বড় নেতা। আবু জাহল, আবু লাহাবও। দীর্ঘ আলোচনা হয় সভায়। অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়। অবশেষে সভায় সিদ্ধান্ত হয়, দুর্ধর্ষ সাহসী আর কঠিন হৃদয়ের লোক মুহাম্মদকে হত্যা করবে।
কিন্তু!
আবু সুফিয়ান যেন একটু থমকে যায়। তারপরই গম্ভীরভাবে বলে, ব্যাপারটি নিয়ে মুহাম্মদের অভিভাবক আবু তালিবের সাথে একটু আলোচনা করা দরকার। এমন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে তাকে রাজি করাতে হবে। তাকে শান্ত রাখতে হবে। ছলে-বলে যে কোনো উপায়েই এ কাজটা আমাদের করতে হবে।
কাউন্সিল সভা থেকেই সবাই যায় আবু তালিবের ঘরে।
অসুস্থ আবু তালিব আরবের সবচে’ সম্মানিত একজন। কুরাইশ বংশের একজন নেতাও। কুরাইশ বংশের এ নেতারই ভাইপো মুহাম্মদ। তিনি এ মুহূর্তে মুহাম্মদের অভিভাবকও। আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে যে দল এসেছে তাতে আবু তালিবের আরেক ভাই আবু লাহাবও আছে।
এমন শক্তিশালী আর ক্ষিপ্ত দলের কাছে আবু তালিব টলেনি। মুহাম্মদও তাদের ভয়ে ভীত হয়নি। খুব একটা সায় পায়নি ওরা আবু তালিবের পক্ষ থেকে। মনোকষ্টে সেখান খেকে ফিরে আসে। আপাতত মুহাম্মদকে হত্যার সিদ্ধান্ত স্থগিত হয়।
কিছুদিন যায়।
আবু সুফিয়ানের মনে স্বস্তি আসছে না। মুহাম্মদের প্রভাব থেকে যে আরবকে রক্ষা করতে হবে। কী করা যায়? আবু লাহাবও স্বস্তিতে নেই। নিজ ভাইপো এমন জঘন্য কথা বলল!
আবার বসে সভা।
আলোচ্য বিষয় একই— মুহাম্মদকে হত্যা করতে হবে। সভার স্থান এবারও আবু সুফিয়ানের ঘর। এবার ভোজেরও আয়োজন আছে। তপ্ত পাথরে রাখা পোড়া গোশত, মেষশাবকের ঘাড়, পঙ্গপালের ভাজি, দুধ, মাখন আর এসবের সাথে আছে প্রিয় মধু ও বার্লির মদ।
এমন মহাভোজের মহা আয়োজন শেষে একদল শপথ নেয় তারা মুহাম্মদকে হত্যা করে তাঁর হাত থেকে আরবকে মুক্ত করবে।
হত্যাকাঙ্ক্ষী দলের নেতা আবু জাহল।
কাবাঘরের এক কোণে কালোপাথরের পাশে দাঁড়িয়ে ইবাদত করছে আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইবাদতরত মুহাম্মদের উপর আক্রমণ করবে আবু জাহল। কাবার পাশে কুরাইশ সরদারদের কামরায় অন্যরা সবাই প্রস্তুত থাকবে। তারা সাথে সাথে এগিয়ে এসে আবু জাহলকে সাহায্য করবে।
আবু জাহল একটা বড় পাথর নিয়ে সেখানে লুকিয়ে রইলো। মুহাম্মদ ইবাদতে যেই নতজানু হলো— অমনি আবু জাহল বেরিয়ে এলো। পাথর মারতে হাত উঁচু করে— ওমা একি! হাত আর নড়ে না যে? মুহাম্মদের মাথার উপর উঁচু করা হাত অচল হয়ে রইলো। ভয়ে চিৎকার দিয়ে দৌড়ে কুরাইশদের কামরায় ফিরে এলো।
অন্যরাও ভড়কে গেলো।
ব্যাপার কী?
বিভিন্ন জন বিভিন্ন প্রশ্ন করছে। আবু জাহল শুধু বলছে, ‘আমি দেখলাম মুহাম্মদ ও আমার মাঝের স্থানে আগুনের পরিখা। ঐ অগ্নিকুণ্ড থেকে আগুনের লেলিহান আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমি সেখানে ক্ষমতাহীন ও ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। এই অদ্ভূত অভিজ্ঞতা স্বপ্ন না বাস্তব তা যা-ই হোক, হুবলের শপথ আমি নিজের চোখে এই আগুনের পরিখা দেখেছি।’
এমনি অদ্ভূত ঘটনায় সেদিন মুহাম্মদকে হত্যা করতে পারেনি আবু জাহল। আওরা মনে মনে ভাবছে, সত্যি কি জাহল আগুনের পরিখা দেখেছে? সেদিন মুহাম্মদকে শেষ করে দিলেই তো আজ আর এমন ‘কাঠকুড়ানী’ অপবাদ শুনতে হতো না।
না, এ বিশ্বাসযোগ্য কথা নয়। আজ সে নিজেই হত্যা করবে মুহাম্মদকে। কে রুখবে তাকে?
লাহাবের পাঠানো সেই অনুগত ও বিশ্বস্ত সহচর ফিরে এসে বলে ঘটনাটি সত্য। লাহাবকে শোনায় নাজিল হওয়া কুরআনের সেই আয়াত—
“আবু লাহাবের দুই হাতই ধ্বংস হয়ে যাবে এবং সে নিজেও ধ্বংস হবে। তার উপার্জিত ধন দৌলত কোনো কাজেই আসবে না। সহসাই সে লেলিহান আগুনে জ্বলতে থাকবে এবং তার স্ত্রীও জ্বলবে। সে (দোযখের) ইন্ধন (কাঠজ্বালানি) বহন করবে। তার গলায় খেজুরের আঁশের পাকানো রশির বেড়ি থাকবে।”
সূরা লাহাবের এ আয়াতগুলো শুনে রাগ আরও বেড়ে যায় আওরার। আবু লাহাবেরও। রাগে আওরা দ্রুত বেরিয়ে যায় আবু জাহলের কাছে। তাঁকে জানায় নিজের মনের ইচ্ছার কথা।
তারপর থেকে সুযোগ খুঁজতে থাকে আওরা।
দিন যায়।
রাত যায়।
সুযোগ আর আসে না। একদিন আসে সুযোগ। লোক মারফত জানতে পারে আবু বকর ও আরও একজন সাথী নিয়ে মুহাম্মদ কাবাঘরে অবস্থান করছে।
ব্যাস!
দ্রুত যায় কাবাঘরের দিকে।
আজ সে প্রতিশোধ নিবেই। হিজুর প্রতিশোধ। ‘হিজু’ মানে কবিতার মাধ্যমে নিন্দা করা। আওরা ধারণা মুহাম্মদ কবিতার মাধ্যমে তাকে কাঠকুড়ানি বলে উপহাস করেছে। তার স্বামীকেও উপহাস করেছে। এমন উপহাস কি সহ্য করা যায়?
মোটেই না।
আর তাই মুহাম্মদকে হত্যা করে মনের জ্বালা মিটাবে। আরবের মানুষকেও মুহাম্মদের জাল থেকে মুক্ত করবে।
কী উত্তেজনা! কী শিহরণ! কী রাগ!
এমনি রাগ আর টান টান উত্তেজনা নিয়ে সে আসে কাবাঘরে। দেখে আবু বকর আর সাথের লোকটি আছে। মুহাম্মদ নেই প্রচণ্ড রাগে আবু বকরকে জিজ্ঞেস করে— মুহাম্মদকে কোথায় পাওয়া যাবে?
— তোমার কী প্রয়োজন?
অত্যন্ত শান্তকন্ঠে আবু বকর জিজ্ঞেস করেন।
— আমি শুনেছি সে আমাকে উপহাস করেছে। আমি হিজুর প্রতিশোধ নেব। পাথর দিয়ে তার দাঁত ভেঙ্গে দেব। তাকে খুন করব।
আবু বকরও সাথে সাথে বলেন, আল্লাহর কসম তিনি তো কবিতাই বলেন না।
সাথের লোকটি সাথে সাথে প্রতিবাদ করে বলে— তোমার লজ্জা হওয়া উচিত। মুহাম্মদ কবি নন যে তোমাকে নিয়ে উপহাস করবেন।
তাঁদের সাথে এতোক্ষণ কথা হলো; কিন্তু মুহাম্মদের দেখা পায়নি আওরা। মুহাম্মদকে না পেয়ে রাগ নিয়েই চলে যায়।
এ ঘটনাটি দেখেছে অনেকেই।
অবাক হয়ে যায় সবাই।
অবাক হবে না কেন? আওরা যখন আবু বকরের সাথে কথা বলছিল, তখন তাঁরই পাশে বসা ছিলেন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আওরা তাকে দেখতেই পায়নি।
অবাক করা কাণ্ডই বটে।
আর তাই তো আবু বকর মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করেন, সে কি! আওরা আপনাকে দেখেনি?
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাথে সাথে উত্তর দেন, ‘যতক্ষণ সে এখানে ছিল, ততক্ষণ একজন ফেরেশতা আমাকে তার দৃষ্টির আড়াল করে রেখেছিল।’ তারপরই তিনি সূরা বনী ইসরাইলের পঁয়তাল্লিশ নম্বর আয়াতটি পড়ে শোনান—
“আর যখন তুমি কুরআন পড় তখন আমি তোমার ও আখেরাতে অবিশ্বাস স্থাপনকারীর মধ্যে প্রচ্ছন্ন পর্দা ফেলে দেই।”
সত্যি আল্লাহর কুদরাত!
কুরআনের এ আয়াত সত্যি বলেই কাফের, আখেরাতে অবিশ্বাসী আওরা হত্যা করতে এসে দেখতে পায়নি দুনিয়ার একমাত্র সেরা মানুষ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে।
এ আড়াল প্রক্রিয়া আল্লাহরই অপার মহিমা।
0 Comments