Ticker

6/recent/ticker-posts

শিশির



news-image
নতুন এপয়েন্টমেন্ট পেয়ে অফিসে ঢোকে সুফলা।
কুশলাদি আর পরিচয়ের শেষ পর্যায়ে যায় একাউন্ট্যান্ট নিয়াজ সাহেবের টেবিলে। নিয়াজ সাহেব একটু থমকে তাকিয়ে থাকেন সুফলার দিকে। খানিক পরে নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন— ও, সরি! বসুন। তা হোম ডিস্ট্রিক কোথায়?
এ প্রশ্নে সুফলা একটু হেসে বলে— জন্ম রাজধানীতেই। তবে পৈত্রিক নিবাসটা নাইবা বললাম।
অনাবিল হাসিতে বুদ্ধিদীপ্ত এ উত্তরে চেয়েই থাকেন সুফলার দিকে। এ চাহনিতেই তিনি মনে মনে ভাবেন, দারুণ তো মেয়েটা! তারপরই সুফলাকে বলেন— থ্যাংকস্। চা চলবে এক কাপ?
— নো। নো। থ্যাংকস্।
সুন্দর ছিমছাম অফিসে প্রথম দিনটা ইনজয়েবল হয়েছে সুফলার। অফিসের সহকর্মীরা বেশ আন্তরিক আর চমৎকার।
একদিন ছুটির পর অফিস থেকে বেরিয়েছে মাত্র, অমনি পেছন থেকে পাশে এসে দাঁড়ান নিয়াজ সাহেব। একটু হেসে বলেন—  সেদিন তো চা খাননি, আজ এক কাপ কফি হয়ে যাক। শুধু এক কাপ কফি।
কথার চমৎকারিত্বে এমন অফারটা ফিরিয়ে দিতে পারেনি সুফলা। তাই মুচকি হেসে বলে— ওকে!
পাশেই এক ফাস্টফুডের দোকানে ঢোকে দুইজন। মাঝামাঝি এক টেবিলে বসে কফির অর্ডার দেয়। সুফলা বলে— অন্য কিছু? সেটা না হয় আমিই…..।
— নো। আজ আমার গেস্ট, অতএব আমিই…..।
— ওকে।
কফি এসে পড়ে। কাপে চুমুক দিতে দিতে নিয়াজ সাহেব বলেন— আমার একটা কথা শুনবেন?
একটু চমকে চোখটা বড়ো করে সুফলা ভাবে চিরাচরিত দৃশ্য। রিলেশনের একটা অফার। যা ভেবেছে তা-ই। সুফলার উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে নিজেই বলে ফেলেন নিয়াজ সাহেব— অফিস ডেকোরাম অফিসে। বাইরে আমি আপনাকে তুমি করে বলবো। আমার খুব ইচ্ছে।
সুফলা কফির কাপটা টেবিলে রেখে মাথাটা নিচু করে থাকে ক্ষণিক। তারপর সাহস নিয়ে বলে— ওকে।
কফিটা একটু দ্রুতই শেষ করে দাঁড়ায় সুফলা। স্মীত হাস্যে শান্ত কণ্ঠে বলে— আজ উঠা যাক।
কোন কথা না বলে সুফলার দিকে তাকিয়ে একটু হাসেন নিয়াজ।
বাসায় ফিরে ভাবনায় পড়ে সুফলা। ভদ্রলোক সরাসরি বলেই ফেললো ‘তুমি’ করে বলবে! কফির অফারও দিলো। অথচ সে নিয়াজ সাহেবকে তুমি বলার প্রস্তাব দেয়নি! আলতো পায়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। তারপর নিজে নিজেই বলে— বাহ! ইনজয়এবল ঘটনা। দেখা যাক ভদ্রলোক কতদূর এগোয়!
সুফলা অফিস করে নিয়মিতই।
নিয়াজ সাহেব খুব একটা নয়— তবে অফিসে থাকাকালীন মাঝে মাঝেই এসে তার কাছে বসেন। হেয়ালিভাবে দু’-চার কথা বলেন। আবার চলে যান। মুখ ফুটে কোন কথাই বলছেন না বলে সুফলা বেশ কৌতূহলে আছে। ইনজয় করছে ব্যাপারটা! মনে মনে হাসে তাই।
আজ অফিসে যাবে না সুফলা। ছুটি নিয়েছে। কোন কারণ নেই— এমনিতেই বাসায় থাকবে।
নাস্তা সেরে মাত্র টিভির সামনে বসেছে। কলিং বেল বেজে ওঠে। দরজা খুলতেই সুফলা ভূত দেখার মতো চমকে যায়। দরজার সামনে নিয়াজ সাহেব। নিজেকে সামলে সুফলা একটু শান্ত হয়ে বলে— আসুন।
রুমে ঢুকে দাঁড়িয়ে থেকেই অনেকটা অযত্নে আনা পাটের ব্যাগের একটা প্যাক কাঁপা কাঁপা হাতে এগিয়ে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে— তোমার জন্যে।
চমকে সুফলাও নিচু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে— কী ওটা?
— শাড়ি।
— শাড়ি?
আরও ভীষণ চমকে যায় সুফলা। তবু নিজেকে সামলে বলে— শাড়ি কেন?
— তুমি পরবে। সাজবে। তারপর…..।
— তারপর কী?
— আমি দেখব। মন ভরে দেখব আর ভাববো।
— কী ভাববেন?
লাজুক একটা হাসি দিয়ে বের হয়ে যান রুম থেকে। সুফলাও উঠে যায় ওর রুমে। শাড়িটা পরে ম্যাচিং চুড়ি, অলঙ্কার আর কসমেটিকে সেজে আসে ড্রইংরুমে।
না, নিয়াজ ফিরে আসেনি। ধীর পায়ে এগিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেটের দিকে আগায়। নিয়াজের দেখা মেলে না। কী ব্যাপার! নিয়াজ সাহেব শাড়ির সাজ দেখতে চেয়েছিল, কিন্তু গেল কোথায় এখন? আসছে না যে? আচ্ছা আজ হঠাৎ উনি শাড়িটা দিলেন কেন? কিংবা সুফলাই বা তাঁর এক কথায় শাড়িটা পরে এলো কেন?
তবে কি সুফলা সত্যি সত্যি প্রেমে পড়েছে? ধ্যাৎ ছাই, কেন তাঁর জন্যে অপেক্ষা?
উঠে গিয়ে সুফলা শাড়ি বদলে ফেলে। নিয়াজ সাহেব কিন্তু আর আসেননি।
তার পরদিনও না।
দুই দিন।
সপ্তাহ।
পেরিয়ে গেল পক্ষকালও। নিয়াজ সাহেব কিন্তু আর আসেনই নি সুফলার বাসায়। এমনকি অফিসেও দেখা মেলেনি। হয়ত ইচ্ছে করে ওর এদিকে আসেননি। কী লজ্জারে বাব্বা!
সকালে অফিসে যেতে বেরোয় সুফলা। গেটে আসতেই ওর এক কলিগ মুহিত সাহেব আসেন। সুফলাকে দেখে বলেন— অফিসে যাচ্ছেন তো?
— হ্যাঁ।
তারপর কেমন যেন অন্যমনস্কভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। একটু ভীতু ভীতু ভাবও। সুফলা উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করে— কী হয়েছে? কোন সমস্যা?
— নিয়াজ সাহেবের খবর জানেন না?
ধক্ করে উঠে বুকটা। লোকটা অবচেতন মনে কিছু একটা ঘটিয়েছে নাকি? ভাবনার ইতি টেনে সুফলা বলে— কী হয়েছে? কোথায় ও? সরি, কোথায় উনি?
— উনি যে হাসপাতালে আপনি জানেন না?
একটু থেমে আবার শান্তকণ্ঠে বলে— আজ কতোদিন যে অফিসে আসেন না, একটুও তো খোঁজ নিলেন না।
সুফলা ব্যাপারটা অন্যভাবে ভেবেছে। দুইজনের প্রতি দুইজনের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়ে যায়— সে ভয়ে কোন খোঁজই নেয়নি। সুফলা এবার শান্ত কণ্ঠে মুহিত সাহেবকে বলে— সরি। আ-স-লে… আমি তো নতুন, বুঝতে পারিনি। ভাবছি উনি হয়ত অফিসের কাজে কোথাও গেছেন। যাক, কী হয়েছে উনার?
— ক্যান্সার। মৃত্যুর পথে এখন।
একদম থমকে যায় সুফলা। মৃত্যুর পথে এখন নিয়াজ সাহেব! ইন্টারনেটের মতোই দ্রুত সব ঘটে গেল! আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না সুফলা। বসে পড়ে গেটের সামনের সিঁড়িতেই।
চোখ মুছতে মুছতে এগিয়ে এসে মুহিত সাহেব শান্ত কণ্ঠে বলেন— আমরা সবাই যাচ্ছি দেখতে, আপনিও চলুন।
মাথাটা তুলে মধ্যম মেজাজী কণ্ঠে সুফলা বলে— আপনাদের সাথে যাব না। আপনারা কেমন মানুষ? এতদিনেও কেন আপনারা আমাকে খবরটা দিলেন না?
— আমরা কি জানি যে আপনি জানেন না?
— তাহলে আজ?
— এখন উনিই আপনাকে দেখতে চেয়েছেন।
— আমাকে! দেখতে চান?
কেমন যেন চুপসে যায় সুফলা। আর কোন কথা না বলে সাথে সাথেই উঠে দাঁড়ায়। তারপর একসাথে রওয়ানা দেয় হাসপাতালের দিকে।
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছেন নিয়াজ সাহেব। আরো অনেক লোক— সহকর্মী, আত্মীয়। সুফলা তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে আলতো ডাক দেয়— নিয়াজ সাহেব।
পাশ ফিরে তাকালেন নিয়াজ সাহেব।
কিছুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। তারপর হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে একদম মৌন কণ্ঠে বলেন— এখানে বসো।
কান্না কান্না ভাব নিয়ে সুফলা বসে বিছানায়।
নিয়াজ সাহেব তেমনি কন্ঠে বলেন— আমার মায়ের শাড়িটা চুরি করে তোমাকে দিয়েছিলাম। ওটা পরিয়ে তোমাকে দেখতে চেয়েছিলাম আমার ছোট্ট বোন বকুলের মতো।
— আপনার বোন বকুল এখন কোথায়?
— ও তো মরে গেছে। এখন ও মহাকালের ক্যানভাসে। ও নেই আমার আঙ্গিনায়, আছ তুমি; শুধু তুমি। তোমাকে ঠিক ওর মতোই মনে হয়। প্রথম দেখাতেই আমার তা-ই মনে হয়েছিল। ও মায়ের এ শাড়িটা পরে প্রায়ই সাজতো। তাই তো…..।
আর কোন কথা না বলে পাশ ফেরেন।
সুফলা দুই হাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ফুপিয়ে ওঠে।

Post a Comment

0 Comments