Ticker

6/recent/ticker-posts

হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা’



news-image
শহরটার নাম হামেলন। সবাই চেনে হ্যামিলন নামে৷ ছোট্ট, সাজানো, সুন্দর শহর হ্যমিলন৷ সেই শহরের মানুষের খুব দুঃখ৷ সেখানে যেন ইঁদুর-বন্যা হয়েছে!
বলছি ১২৮৪ সালের কথা৷ এখন থেকে ৭০০ বছর আগের কথা। হাজারে হাজারে ইঁদুর এখানে-সেখানে। ঘরের মধ্যে যাও সেখানেও ইঁদুর! এই ধরো কোনো বাচ্চা স্কুলে যাবে, ব্যাগ গোছাচ্ছে, দেখা গেল ঐ ব্যাগের মধ্যে গোটা পাঁচেক ইঁদুরছানা৷ কিংবা স্কুলের খেলার মাঠে শিশুদের পা খামচে ধরছে ইঁদুর৷ কী যে যাচ্ছেতাই অবস্থা! শহরের মেয়র পড়েছেন ভারী বিপদে৷ নগর-পিতার ঘুম নেই৷ কী করবেন তিনি…
এমনই এক ইঁদুরদিনে হ্যামিলনে এসে পৌঁছালো আজব এক লোক৷
লোকটির পরনে খাটো নানান রঙ্গের আলখাল্লা, মাথায় চোঙ্গার মতো উপরে উঠে ঝুলে পড়া টুপি৷ হাতে লম্বা এক বাঁশি৷ আহা কী সুন্দর করেই না বাঁশি বাজায় লোকটি…!
শহরের মধ্যখানে মেয়রের অফিস৷ একসময় সেখানকার রোদে গা জুড়াতো মানুষ। আজ আর সেই অবস্থা নেই৷ লোকজন ঘরে কোনোভাবে দিন কাটায়৷ অফিস-আদালতের কাগজপত্র কেটে-কুটে একাকার করে দিচ্ছে ইঁদুর আর ইঁদুরছানারা৷
শহরের গণ্যমান্য লোক তাই বসেছেন সভায়— কী করা যায় সেই চিন্তায় সকলের কপালে পড়ে গেছে ভাঁজ৷ তখন ঐ সভায় এসে পৌঁছালো সেই অদ্ভুত বাঁশিওয়ালা…
‘আমি আপনাদের সমস্যা সমাধান করে দিতে পারি৷ আমি হচ্ছি ইঁদুর শিকারী৷ আমি এই শহর থেকে তাড়িয়ে দিতে পারি সব ইঁদুর।’ বাঁশিওয়ালা বললো।
মেয়র একটু ভ্রূ কুঁচকে বললেন, ‘বিনিময়ে তুমি কী চাও?’
তখনই সমস্বরে সেখানে উপস্থিতরা বলে উঠলেন, ‘তুমি যা চাও আমরা তাই দেবো৷ টাকা চাও, সোনা চাও, জমি চাও, ঘর চাও, বাড়ি চাও সব তোমাকে দেবো, কেবল আমাদের রক্ষা করো৷’
লোকটি একটু হাসলো৷ তারপর বাইরে বের হয়ে নিজের রঙিন আলখাল্লাটার মধ্য থেকে দারুণ একটি বাঁশি বের করলো… তারপর
সেই বাঁশি বাজাতে বাজাতে ঘুরতে থাকলো হ্যামিলনের পথে৷ সে বাঁশির এক অচেনা সুরের আকর্ষণে শহরের হাজার হাজার ইঁদুর দলবেঁধে ছুটছে লোকটির পেছনে পেছনে৷ নর্দমার গর্ত থেকে, অন্ধকার গলি থেকে, রান্নাঘরের পেছন থেকে দলে দলে বেরিয়ে আসছে ইঁদুর৷ সুরের সম্মোহনে পাগল যেন ইঁদুরের দল!
ঐ শহরের পাশে যে নদী তার নাম ভেজার/ওয়েজার। লোকটি থামলো না— ভেজার নদীর পাশ দিয়ে হাঁটতে শুরু করলো সে৷ আর তাঁর পিছু অদ্ভুত সুরের মূচ্ছর্নায় আসতে থাকলো ইঁদুরের দল৷ একসময় বাঁশিওয়ালার বাঁশির সুর থেমে গেল৷ কী এক চক্রবাঁকে যেন এক উন্মাদনা এসে ভর করলো ইঁদুরের দলে৷ আর সেই উন্মাদনাতেই ইঁদুরেরা দলবেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়লো নদীর জলে…
হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা এভাবেই ইঁদুরের কবল থেকে রক্ষা করলো শহরবাসীকে৷ কিন্তু এরপর?
ইঁদুর বিদেয় হবার পর শহরের মেয়র আর শহরের গণ্যমান্য লোকদের কাছে এসে চাইলো তার সম্মানী৷ কিন্তু কী হলো তারপর? মেয়র এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা প্রাপ্য সোনাদানা তো দিলই না, বরং ধমকে তাড়িয়ে দিল বাঁশিওয়ালাকে৷
বাঁশিওয়ালা খুবই দুঃখ পেল৷ তার চোখে পানি৷ প্রতিশোধ নেবার বাসনা তার মধ্যে৷
কিছুদিন পর যখন শহরের লোকজন তাদের গীর্জায় প্রার্থনারত, সেই ক্ষুব্ধ, প্রতারিত বাঁশিওয়ালা ফিরে এল আবার৷ এবার তার মাথায় লম্বা লাল রঙের টোপর৷ গায়ে জড়ানো অদ্ভুত পোশাকটি অনেক লম্বা৷ সেই পোশাক থেকে বের করলো একটি ছোট্ট বাঁশি৷ সেই বাঁশিটি বেজে উঠলো; কিন্তু এবার বাঁশির সুর একেবারেই ভিন্ন৷ সেই সুরে এবার আর ইঁদুর বেরিয়ে এল না; বেরিয়ে এল শহরের সমস্ত শিশুর দল৷ সুরের মূর্চ্ছনায় বাঁশিওয়ালার পেছনে পেছনে সরু পথ থেকে বড় পথ, পাহাড়ের কোল থেকে নদীর কূল পর্যন্ত এগিয়ে যাচ্ছে শিশুর দল৷ এই দলে আছে শহরের মেয়রের আদরের কন্যাও৷ এরপর বাঁশিওয়ালা শিশুদের নিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেলো৷ এই পাহাড়, ঐ নদী, পাশের শহর সব জায়গা খুঁজেও পাওয়া গেল না সেই শিশুদের; পাওয়া গেল কেবল দুটি শিশুকে৷ মিছিলের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারার কারণে পিছিয়ে পড়েছিল বলে তাদের ফিরে আসতে হলো৷ তাদের একজন অন্ধ বলে জানতে পারলো না— কোথায় গেল সবাই! আরেকজন বোবা বলে জেনেও কিছু বলতে পারলো না…
এর পর আর কোনোদিন দেখা যায়নি হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালাকে৷।

Post a Comment

0 Comments