উত্তরঃ
(ক) নিম্নে “ক্ষুদ্র জাতিসত্তা”র ধারণা দেওয়া হলােঃ
এথনিক জাতিসত্তা হচ্ছে নিজস্ব পরিচিতি সম্পন্ন জনসম্প্রদায় বা বর্গ। তারা ভাষা, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, ইতিহাস ইত্যাদির আলােকে বিশেষ পরিচিতি লাভ করে এবং অনুরূপ সম্প্রদায় থেকে নিজেদের পৃথক করে থাকে। রক্ত ও বৈবাহিক সম্পর্ক, অর্থনৈতিক কার্যক্রম ও ভাষা এথনিক গ্রুফের মানুষজনের মধ্যে অটুট বন্ধন সৃষ্টি করে। নিজেদের বন্ধন ও অন্যান্য জন গােষ্ঠী থেকে পা্থক্য এথনিক গ্রুফের মানুষের মনে সম্প্রদায় চেতনা জাগ্রত করে।
(খ) নিন্নে উপজাতীয়দের “সাংস্কৃতিক উৎসবে”র বর্ণনা দেওয়া হলােঃ
উপজাতিরা এক উৎসব প্রিয় জাতি। জন্মের পর থেকেই ধর্মীয়, সামাজিক এবং ঋতু ভেদে বিভিন্ন উৎসব আনন্দ মেতে উঠেন তারা। উৎসব মুখর জীবন যাপন করে সারাজীবন। ত্রিপুরাদের বৈইসুক, মারমাদের সাংগ্রাই এবং চাকমাদের বিজু উৎসব কে একত্রে বৈসাবি বলা হয়। বৈসাবি নিয়েতাে আমরা কম বেশি অনেকেই জানি। উপজাতিদের হাজারাে উৎসব থেকে কিছু কিছু উৎসব সম্পর্কে নিম্নে আলােচনা করা হলােঃ
কারাম উৎসবঃ সাঁওতাল, ওঁরাও, মালাে, মুন্ডা, মাহাতাে, ভুইমালি সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব পালন করে। কারাম উৎসব নামক একটি বড় পূজা করে তারা। এটি তাদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান। এই পূজার রীতিনীতি হচ্ছে কারাম গাছের ডালকে ঘিরে। কারাম নামক গাছের ডালকে ঘিরে এ পৃজা হয় বলে এই উৎসবকে ডাল পূজাও বলা হয়।
ঋতু ভেদে উৎসবঃ সাঁওতালরা বারো মাসে তেরাে উৎসব পালন করে। এক কথায় এরা উৎসব মুখর জাতি। তাদের নতুন বছর শুরু হয় ফাল্গুন মাসে। নববর্ষে পালিত হয় বাহা উৎসব। নাচ গান করে আগমন করে নতুন বছরের। এছাড়াও এরা প্রতি ঋতুতে ভিন্ন ভিন্ন উৎসব পালন করে থাকে। যেমন- চৈত্র মাসে পালন করে বােঙ্গাবােঙ্গি, বৈশ্বাখে হােম, জ্যৈষ্ঠমাসে এরাে, আষাঢ় মাসে হাঁড়িয়াও, আশ্বিনে দিবি, পৌষ শেষে সােহরাই। বসন্তে তারা পালন করে ফুলফোটা উৎসব। বসন্ত উৎসবে তরুণ তরুশীরা তাদের সঙ্গী নির্বাচনের সুযােগ পায়।
সােহরাই উৎসবঃ সাঁওতাল জনগােষ্ঠীর একটি আকর্ষণীয় উৎসব হচ্ছে সােহরাই উৎসব। তাদের জীবনে প্রাণীর গুরুত্ব অপরিসীম। তাই তাদের গৃহপালিত পশুদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করার জন্য সােহরাই উৎসব পালন করে এই আদিবাসী সম্প্রদায়। সােহরাই উৎসবের দিন সাঁওতাল গ্রামের মহাজনরা সভা ডেকে আগে থেকে দিন নিরধরিণ করে। তবে পৌষ বা মাঘ মাসের দিকে এই উৎসব পালন করা হয়। এই উৎসবের একটি রীতি হচ্ছে সাঁওতাল মেয়েরা তাদের বাপের বাড়ি যাওয়ার নেমত্তন পায়।
রাখাইন উৎসবঃ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইনরা জন্মান্তরবাদ ও কর্মবাদে বিশ্বাসী। রাখাইন আদিবাসীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব বুদ্ধ পূ্ণিমা। এছাড়াও আশ্বিনী পুণ্ণিমা,কঠিন চীবর দান উৎসব এবং আষাট়ী পূর্ণিমার মত ধর্মীয় অনুষ্ঠান এরা পালন করে থাকে। রাখাইনদের বর্ষবরণের উৎসবকে বলা হয় সাংগ্রেই। বছরের নতুন দিনের আনন্দে তৈরি হয় নানা রকমের পিঠাপুলি, বিন্নি ধানের ভাত।
গারাে উৎসবঃ গারােদের বেশ কিছু উৎসবের মধ্যে আগাল মাক্কা বা আচিরক্কা, রংচু গাল্লা, জামে গাপ্পা-আহাওয়া, ওয়ানগালা অন্যতম। গারাে সমাজে সম্তান জন্মদান পুরাে গ্রামের জন্যে উৎসবের আমেজ থাকে। সবাই ওইদিন চু-জাঙ্গি মদ পান করে। তাদের পালিত ওয়ানগালা উৎসবটি বেশ আকর্ষণীয়।
(গ) বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসম্ভার পরিচয় নিম্নে দেওয়া হলােঃ
বাংলাদেশে ৪৫টির মত ক্ষুদ্র জাতিগােষ্ঠী আছে। যেমন চাকমা, ত্রিপুরা, সাঁওতাল, মান্দাই, মনিপুরী, খাসিয়া ইত্যাদি। বাংলাদেশ রাষ্ট্রে ক্ষুদ্র জাতিগােষ্ঠীর অবস্থান প্রাক্তিক। এথনিক গ্রুফ গুলাের প্রতি আধিপত্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নেতিবাচক। ক্ষুদ্র গ্রুফ গুলাের ভাষা ও অর্থনীতি হুমকীর সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। ক্ষুদ্র গ্রুফের রাষ্ট্র কর্তৃক আক্রমণের শিকার হয় আধুনিক রাষ্র গঠনের পর। আধুনিক রাষ্ট্রেক্ষুদ্র জাতিগােষ্ঠীগুলির অধিকারের প্রশ্ন সামনে আসে। কিন্তু রাষ্ট্র জাতীয় সংহতির প্রশ্নে খুদ্র জাতিগােষ্ঠীগুলির উপর আধিপত্য বিস্তারে সচেষ্ট হয়ে উঠে।
(ঘ) নিম্নে ক্ষুত্র জাতিসত্তার সাংস্কৃতিক উৎসবের বিবরণ দেওয়া হলােঃ
চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরাদের প্রধান উৎসব উদযাপিত হয় চৈত্রমাসের শেষ দুই দিন ও বৈশাখের প্রথম দিন। পুরাতন বছরকে বিদায় জানানাের ও নতুন বছরকে আহ্বান জানানাের উৎসবে পানাহার, ঘুরে বেড়ানাে, আত্মীয়দের সঙ্গে সাক্ষাত, নাচ-গান ও সকলে একত্রে আনন্দ করার জন্য উৎসব সাজানাে হয়। চাকমাদের এই উৎসবের নাম বিজু। মারমাদের উৎসবের নাম “সাংগ্রাই” ও ত্রিপুরাদের উৎসবের নাম “বৈসুক।” এই তিনটি গােষ্ঠী এখন একত্রে “বৈসাবি” নামে উক্ত উৎসব পালন করে।
মনিপুরীদের অন্যতম জাঁকজমকপূর্ণ উৎসব হচ্ছে বিষ্ণুপ্রিয়া হােলি উৎসব। এ উৎসবটি উদযাপিত হয় চৈতন্য দেবের জন্ম উপলক্ষে। ১১৮৬ সালে ফাল্গুন মাসের দোল পূর্ণিমার সন্ধ্যায় চন্দ্র গ্রহণের সময় তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। মনিপুরীদের আদি অপ্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম “আপােকপা” এর বিশ্বাসের সঙ্গে বৈষ্ণব ধর্ম সংযােজিত হয়ে মিশ্র ধর্ম বিশ্বাসের জন্ম হয়। বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরীদের জীবনে কৃষ্ণপ্রেমই ঈশ্বরের সাধনা। আর চৈতন্যের জন্ম তিথিতে বাঁশ ও খড় দিয়ে তারা তৈরী করেন ঘরের ভিতর আরেকটি ছােট ঘর।
এই ঘবরের ভিতর ঘর চৈতন্যের ঘরের প্রতীক। এটি মনিপুরীদের গাহস্থ্য জীবনের প্রতীক। পাঁচদিন ধরে মনিপুরীগণ ছােট বড়, নারী পুরুষ সকলে একত্রে আনন্দ উল্লাস ও রং খেলায় মেতে থাকেন। ঔঁরাওদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব “কারাম উৎসব।” একটি পাতাময় গাছ পুতে তার নীচে ডুমুর, সুপারী, জল, মানকচু, দুধ, চিড়া দিয়ে তারা প্রকৃতির পূজা করেন। সাতদিন ধরে জনগােষ্ঠীর সকলে নাচে গানে আনন্দে মাতােয়ারা হয়ে যান।
আর সাত ভাইয়ের কাহিনী শােনেন। সাতভাই এর বড় ভাই কারাম ধারাম বাড়ীতে বসে না থেকে বাণিজ্য করতে যান ও সাতদিন পর ফিরে আসেন। কর্মকে ধর্ম জ্ঞান করা ঁরাওদের জীবন দর্শন। এটিই ওঁরাওদের ধর্ম। অনেক ক্ষুদ্র জাতিগােষ্ঠীর জীবিকা ছিল শিকার। বনাঞ্চলের উপর তারা নির্ভরশীল ছিলেন। ঐতিহ্যগতভাবে ক্ষুদ্র জাতিগােষ্ঠীর মানুষজন প্রকৃতি প্রেমিক।
0 Comments