সেলের তালা খোলা মাত্রই এক টুকরো রোদ এসে পড়লো ঘরের মধ্যে আজ তুমি আসবে । সারা ঘরে আনন্দের শিহরণ খেলছে । যদিও উত্তরের বাতাস হাড়েঁ কাঁপন ধরিয়ে দিয়ে বইছে , তবু আমিঠান্ডা পানিতে হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। পাহারাদার সেন্ট্রিকে ডেকে বললাম, আজ তুমি আসবে । সেন্ট্রি হাসতে হাসতে আমার সিগ্রেটে আগুন ধরিয়ে দিল । বলল , বারান্দায় হেটেঁ ভুক বাড়িয়ে নিন দেখবেন , বাড়ী থেকে মজাদার খাবার আসবে । দেখো , সবাই প্রথমে খাবারের কথা ভাবে । আমি জানি বাইরে এখন আকাল চলছে । ক্ষুধার্ত মানুষ হন্যে হয়ে শহরের দিকে ছুটে আসছে । সংবাদপত্রগুলোও না বলে পারছে না যে এ অকল্পনীয় । রাস্তায় রাস্তায় অনাহারী শিশুদের মৃতদেহের ছবি দেখে আমি কতদিন আমার কারাকক্ষের লোহার জালি চেপে ধরেছি । হায় স্বাধীনতা , অভুক্তদের রাজত্ব কায়েম করতেই কি আমরা সর্বস্ব ত্যাগ করেছিলাম । আর আমাকে ওরা রেখেছে বন্দুক আর বিচারালয়ের মাঝামাঝি যেখানে মানুষের আত্মা শুকিয়ে যায় । যাতে আমি আমরা উৎস খুঁজে না পাই । কিন্তু তুমি তো জানো কবিদের উৎস কি ? আমি পাষাণ কারার চৌহদ্দিতে আমার ফোয়ারাকে ফিরিয়ে আনি । শত দুর্দৈবের মধ্যেও আমরা যেমন আমাদের উৎসকে জাগিয়ে রাখতাম । চড়ুই পাখির চিৎকারে বন্দীদের ঘুম ভাঙছে । আমি বারান্দা ছেড়ে বাগানে নামলাম। এক চিলতে বাগান ভেজা পাতার পানিতে আমার চটি আর পাজামাভিজিয়ে চন্দ্রমল্লিকার ঝোপ থেকে একগোছা শাদাআর হলুদ ফুল তুললাম । বাতাসে মাথা নাড়িয়ে লাল ডালিয়া গাছ আমাকে ডাকলো । তারপর গেলাম গোলাপের কাছে । জেলখানার গোলাপ , তবু কি সুন্দর গন্ধ ! আমার সহবন্দীরা কেউ ফুল ছিড়েঁ না , ছিঁড়তেও দেয় না কিন্তু আমি তোমার জন্য তোড়া বাঁধলাম । আজ আর সময় কাটতে চায়না । দাড়ি কাটলাম । বই নিয়ে নাড়াচাড়া করলাম । ওদিকে দেয়ালের ওপাশে শহর জেগে উঠছে । গাড়ীর ভেঁপু রিক্সার ঘন্টাধ্বনি কানেআসছে । চকের হোটেলগুলোতে নিশ্চয়ই এখন মাংসেরকড়াই ফুটছে । আর মজাদার ঝোল ঢেলে দেওয়া হচ্ছে গরীব খদ্দেরদের পাতে পাতে । না বাইরে এখন আকাল । মানুষ কি খেতে পায় ? দিনমজুরদের পাত কি এখন আর নেহারির ঝোলে ভরে ওঠে ? অথচ একটা অতিকায় দেয়াল কত ব্যবধানই নাআনতে পারে । আ , পাখিরা কত স্বাধীন । কেমন অবলীলায় দেয়াল পেরিয়ে যাচ্ছে জীবনে এই প্রথম আমি চড়ুই পাখির সৌভাগ্যে কাতর হলাম । আমাদের শহর নিশ্চয়ই এখন ভিখিরিতে ভরে গেছে । সারাদিন ভিক্ষুকের স্রোত সামাল দিতে হয় । আমি কতবার তোমাকে বলেছি , দেখো মুষ্টি ভিক্ষায় দারিদ্র্য দূর হয় না । এর অন্য ব্যবস্হা দরকার , দরকার সামাজিক ন্যায়ের । দুঃখের শিকড় উপড়ে ফেলতে হবে । আ , যদি আমার কথা বুঝতে । প্রিয়তমা আমার , তোমার পবিত্র নাম নিয়ে আজ সূর্য উদিত হয়েছে । আর উষ্ণ অধীর রশ্মির ফলা গারদের শিকের ওপর পিছলে যাচ্ছে । দেয়ালের ওপাশ থেকে ঘুমভাঙ্গা মানুষেরকোলাহল । যারা অধিক রাতে ঘুমোয় আর জাগে সকলের আগে । যারা ঠেলে । চালায় । হানে । ঘোরায় । ওড়ায় । পেড়ায় । আর হাত মুঠো করে এগিয়ে যায় । সভ্যতার তলদেশে যাদের ঘামের অমোঘ নদী । কোনদিন শুকোয় না । শোনো , তাদের কলরব । বন্দীরা জেগে উঠছে । পাশের সেলে কাশিরশব্দ আমি ঘরে ঘরে তোমার না ঘোষণা করলাম বললাম , আজ বারোটায় আমার ‘দেখা’ । খুশীতে সকলেই বিছানায় উঠে বসলো । সকলেরই আশা তুমি কোন না কোন সংবাদ নিয়ে আসবে । যেন তুমি সংবাদপত্র ! যেন তুমি আজ সকালের কাড়জের প্রধান শিরোনামশিরা! সূর্য যখন অদৃশ্য রশ্মিমালায় আমাকে দোলাতে দোলাতে মাঝ আকাশে টেনে আনলো ঠিক তখুনি তুমি এলে । জেলগেটে পৌছেঁ দেখলাম , তুমি টিফিন কেরিয়ার সামনে নিয়ে চুপচাপ বসে আছো । হাসলে , ম্লান , সচ্ছল । কোনো কুশল প্রশ্ন হলো না । সাক্ষাৎকারের চেয়ারে বসা মাত্রই তুমিখাবার দিতে শুরু করলে । মাছের কিমার একটা বল গড়িয়ে দিয়ে জানালে , আবরা ধরপাকড় শুরু হয়েছে । আমি মাথা নাড়লাম । মাগুর মাছের ঝোল ছড়িয়ে দিতে দিতে কানের কাছে মুখ আনলে , অমুক বিপ্লবী আর নেই আমি মাথা নামালাম । বললে , ভেবোনা , আমরা সইতে পারবো । আল্লাহ , আমাদের শক্তি দিন । তারপর আমরা পরস্পরকে দেখতে লাগলাম । যতক্ষণ না পাহারাদারদের বুটের শব্দ এসে আমাদের মাঝখানে থামলো ।
0 Comments